*** বাঙালির কষ্টের মাস আগস্ট। শােকসিক্ত একটি দিন পনেরাে আগস্ট। *** *** পঁচাত্তরের এ দিনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নির্মমভাবে নিহত হন। হাজার বছরের ঐতিহ্যসমৃদ্ধ বাঙালির পরাধীনতার গ্লানি কাটিয়ে তাঁর নেতৃত্বেই বীর-বাঙালি ছিনিয়ে এনেছিল চূড়ান্ত বিজয়। বিশ্ব-মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন সার্বভৌমত্ব একটি রাষ্ট্রের মহান অভ্যুদয়ের তিনি ছিলেন অকুতােভয়-অদম্য । আপন জীবন বিপন্ন করে যিনি ছিলেন বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভাের; তার বুকের পবিত্র রক্ত ঝরিয়ে সেদিন যারা উল্লাসে মেতেছিল তাদের কূটচালের কাছে আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র অনেকটাই অসহায়। তাই আজও আমরা জাতির জনকের যােগ্য স্বীকৃতি দিতে পারিনি। বিচারের আওতায় আনতে পারিনি সেইসব আত্মস্বীকৃত খুনিদের। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে প্রায় উনিশ বছর পর আমরা স্বাধীনতা পেয়েছিলাম। পেয়েছিলাম প্রিয় বাংলাদেশ। একটি লাল সবুজ পতাকা। প্রতিদিন বাতাসের ঘাড়ে এত রক্ত দুলছে তবু আমরা আমাদের চেতনায় আগুন জ্বালাতে পারিনি। পােড়াতে পারিনি হিংসা-বিদ্বেষ আর দুর্নীতির জ্বণ। যে রাজপথ এখনাে শহীদের রক্ত বুকে স্থির, যে বৃক্ষের পাতায় পাতায় এখনাে সবুজের দীর্ঘ কান্না, সেই পথ হেঁটে সেই বৃক্ষের ছায়ায় বসে এখনাে আমাদের প্রধান এবং প্রথম কাজ-জনকহীন দেশপ্রেমের ব্যবচ্ছেদ। তাহলে এতাে বছর পাড়ি দেবার কী প্রয়ােজন ছিল? কী প্রয়ােজন ছিল লাখাে মৃত্যু আর নির্যাতনের ক্ষেত্র প্রস্তুতির পশ্চিমপাকিস্তানের স্বৈরতন্ত্রের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে এই দৌড়ের অর্থ কী? মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার আর স্বাধীনতা-প্রাপ্তির খাতায় একটি নাম লেখানাে ছাড়া তার অন্য কোনাে পাতায় একটিবারও কি মােটা অক্ষরে সমৃদ্ধি শব্দটি লিখতে পেরেছি? ‘দেশপ্রেম' শব্দটি লিখতে পেরেছি? স্বীকৃতি দিতে পেরেছি জাতির জনককে? এই ব্যর্থতার দায় কার? আমাদের সবার, নাকি স্বপ্নের বিপক্ষে দাঁড়ানাে কিছু স্বার্থন্বেষী মানুষের। উর্দুর বিপরীতে এখন ইংরেজি আমাদের শব্দটির মাথায় চেপে বসেছে পরাধীনতা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা। তিনি বাঙালি জাতিকে একত্রিত করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। একথা অস্বীকার করার অর্থই হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশকে অস্বীকার করা। যুগ যুগ ধরে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আমরা আবদ্ধ ছিলাম । দুশাে বছর ইংরেজশাসনের পর ১৯৪৭ সালে আসে নামমাত্র স্বাধীনতা। এ সুযােগে বাংলাদেশের মানুষকে শােষণ করে পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী তাদের অঞ্চলকে সমৃদ্ধ করতে থাকে। তারই অনিবার্য পরিণতিতে শুরু হয় শাসনশােষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। বাংলার জনগণের জন্য একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের একমাত্র স্বপ্ন ছিল বঙ্গবন্ধুর। তাই তিনি ১৯৪৭ সালের আগেই ইংরেজ ঔপনিবেশিকতাবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু ও তার সুযােগ্য সহযােগীরা ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে ডেমােক্র্যাটিক ইয়ুথ লীগ গঠন করেন। কিন্তু তাত্ত্বিকতা ও বাস্তবতার মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয় না-থাকার ফলে সে প্রতিষ্ঠান দাঁড়াতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছিলেন—“দেশের মানুষকে না গড়ে, দেশের মানুষকে মবিলাউজড না করে পরিষ্কার আদর্শ না নিয়ে চলা যায় না।' ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী বাংলা ভাষা ও কৃষ্টির ওপর আঘাত হানে। উর্দুকে চাপিয়ে দিতে চায় বাংলা-ভাষাভাষি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ওপর। ১৯৪৮ সালের ৫ জানুয়ারি ছাত্রলীগের জন্ম ভাষা-আন্দোলনের দাবিকে আরও জোরালাে করে তােলে। ভাষা-আন্দোলনের জন্য বঙ্গবন্ধু কারাবরণ করেন। ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা বাংলার মাঠে-প্রান্তরে, গ্রামে গ্রামে কীভাবে চারণের মতাে তিনি নিরলস কাজ করে গেছেন তার হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা করেন। সেই সভায় তিনি নেতাকর্মীর আত্মত্যাগ, বাঙালি জাতির জীবন উৎসর্গ এবং দেশগঠনে তাদের করণীয় সম্পর্কে মূল্যবান পরামর্শ ও উপদেশ দেন, যা সবসময় জাতির জন্য করণীয় ও আদর্শ হয়ে আছে। ১৯৫৫ সালে ‘আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পর থেকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে শুরু হয় বাংলার পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন। বাংলাদেশের মানুষের অধিকার আদায়ের আপসহীন সংগ্রাম। বারবার বিপন্ন জীবনের মুখােমুখি জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম অব্যাহত রাখেন। দীর্ঘ নয় মাস সশস্ত্র যুদ্ধ, ত্রিশ লাখ মানুষের আত্মদান, তিন লাখ নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে লেখা হয় এক মহান বিজয়ের মহাকাব্য। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করলেও বঙ্গবন্ধু বিজয়ীর বেশে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ফিরে আসেন স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে। ফিরে আসেন তার প্রিয় জনগণের মাঝে। শুরু হয় দেশ গড়ার কাজ; জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের নতুন সংগ্রাম। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধুর ফাঁসির হুকুম হয়। কিন্তু বিশ্ব-জনমতের চাপে পাকিস্তানি জল্লাদরা তা কার্যকর করার সাহস পায়নি। অথচ স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের প্রেতাত্মা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে। স্বাধীনতা অর্জনের পর তিন যুগ অতিক্রম হলেও আমরা আমাদের জাতির পিতাকে যােগ্য স্বীকৃতি দিতে পারিনি। অথচ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সমৃদ্ধ এবং সঠিক ইতিহাস বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জানাতে সঠিক ইতিহাস প্রণয়ন প্রয়ােজন। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির জনক স্বীকৃতির বিষয়টি কেন বারবার পিছিয়ে যায়? প্রশ্ন ওঠে? কারা প্রশ্ন তােলে? তাঁর হত্যার দিবসটি কেন জাতীয় শােক দিবস হিসেবে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পালন করা হয় না? জাতি হিসেবে আমাদের অস্তিত্বগাঁথা এতাে ম্লান হবে কেন? যাঁর আত্মত্যাগ ছাড়া স্বাধীন দেশের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যেত; তাঁকে যথাযথ মূল্যায়নে কোনাে বাধা থাকা উচিত নয়। এবারের ১৫ আগস্ট জাতীয় শােক দিবস হিসেবে পালন করে তাঁর আত্মাকে কিছুটা হলেও শান্তি দিতে পারি, শশাধ করতে পারি রক্তের ঋণ। প্রয়ােজনে সংবিধানে হাজার অনুচ্ছেদ যুক্ত হলেও ক্ষতি নেই। বরং এতে সংবিধানের একটি প্রকৃত শূন্যতার অবসান হবে। ***


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আজ রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের সম্মানে ৩০ লাখ বৃক্ষ রোপন কর্মসূচির উদ্বোধন করলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মহামান্য রাষ্ট্রপতি এডভোকেট জনাব মো: আব্দুল হামিদ, সাবেক রাষ্ট্রপতি আলহাজ্ব হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া...